“একটা সময়ে আমিও কর্মজীবী শিক্ষার্থী ছিলাম। অনেকেই আমাকে সাহায্য করেছে তাই আমারও কিছু দায়বদ্ধতা আছে।”
সমাজের
প্রতি এই দায়বদ্ধতা আর নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে, সমাজের ঝরে পড়া কর্মজীবী, সুবিধা বঞ্চিত
এবং পথশিশুদের শিক্ষার ধারায় ফিরিয়ে আনতে দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে অলোক দাস। তার
এই নিরলস পরিশ্রম আর ত্যাগ একদিন উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রাখবে বলে মনে
করেন অনুশীলন মজার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অলোক দাস।
মানুষ
যখন নিজের স্বার্থ আর কর্ম নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই সদ্য অনার্স পাশ করা এক বেকার যুবকের
মাথায় সমাজ গড়ার চিন্তা। নিজের শৈশব, কৈশরে বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনুভুতিই
যেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করার। যখন কোন সুবিধা বঞ্চিত
শিশু সামনে আসে তখনই নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়, বলছিলেন অলোক দাস।
ছাত্র
জীবনে অনেক টানা-পোড়েনের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন অলোক দাস। বিভিন্ন সময়ে বাঁধা আসলেও থেমে
থাকেনি লেখা পড়া। নিজের মনোবল আর প্রবল ইচ্ছায় অর্থনীতিতে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন
করেছেন তিনি। একটা সময়ে নিজের লেখা-পড়াকে সামনে এগিয়ে নিতে কাঠমিস্ত্রির কাজও করতে
হয়েছে তাকে। ব্যক্তি জীবনের এই তিক্ত অবিজ্ঞতা থেকেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন একজন
সুবিধা বঞ্চিত শিশুর অনুভ‚তি এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। যা ছিলো ‘অনুশীলন মজার
স্কুল’ প্রতিষ্ঠার একমাত্র অনুপ্রেরণা।
২০১৫
সালের পহেলা অক্টোবর, ১৫ জন পথশিশু নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া এই স্কুলটির শুরুটা অন্যান্য
স্কুলের থেকে একটু ভিন্নভাবে। নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম না থাকলেও ছিলো নিয়মিত শিক্ষা
দান কর্মসূচী। জামা-কাপড়, খাবার-দাবার ইত্যাদি বিষয়ের লোভ দেখিয়ে একত্রিত করা হতো শিশুদের।
ওদের ভীতর যে উশৃঙ্খলা তা দূর করে খেলা-ধুলার মাধ্যমে ওদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনা, চিন্তা
শক্তির বিকাশ এবং নৈতিকতা প্রবেশ করানোর পাশাপাশি
প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া ছিল স্কুলটির প্রাথমিক কাজ।
২০১৯
সালে, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মু হা আব্দুল কাসেম স্যারের পরামর্শে স্কুলের কার্যক্রম
শুরু করা এবং পরবর্তীতে উপজেলা থেকে আমাদেরকে বই এবং কিছু শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা
হয়। এভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় অনুশীলন মজার স্কুল, বলছিলেন অলোক দাস।
স্কুলের সূচনালগ্নে অনেকেই পাশে থাকার আশ্বাস দিলেও পাশে ছিলোনা কেউ তবে অল্প কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী সমর্থন দিয়েছিলো। যদিও পরবর্তীতে অনেকেই সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তবে এখনো অধিকাংশ খরচ নিজস্ব অর্থায়নে বহন করতে হয়। বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ দান করা হয় তবে আগামীতে পঞ্চম শ্রেণীতে উন্নিত করা হবে বলে জানান অনুশীলন মজার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অলোক দাস।
বর্তমানে
এই স্কুলটি থেকে বাসস্থান বাদে সকল প্রকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়।
যেমন, স্নেহ ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংক্রান্ত
বিষয়েও হস্তক্ষেপ করা হয়। তাছাড়া, স্কুলের পোশাক, যাতায়াতের জন্যে ভ্যান, বছরে তিন
বার নতুন জামা কাপড় দেওয়া, বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা, প্রাথমিক
চিকিৎসা এমনকি শীতে শীতবস্ত্র, ঈদে ঈদবস্ত্র, কুরবানিতে গোস্ত এবং উপজেলা থেকে বিভিন্ন
ধরণের খাদ্য সামগ্রী এনে এখানে বণ্টন করা হয়। তবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারনে এই স্কুলটি
নিয়ে অনেক পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হচ্ছেনা।
বর্তমানে
স্কুলটির দুইটি শাখা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তবে অলোক দাস মনে করেন, একটা সময়ে
বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় এরকম ‘অনুশীলন মজার স্কুলের’ একটি করে সেন্টার থাকবে। যেখানে
মুক্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ঝরে পড়া শিশুদের সংগ্রহ করে প্রাথমিক শিক্ষায়
ভর্তি করাবে, এবং কারিগরি শিক্ষা দিয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ বানিয়ে ছেড়ে দিবে। পরিণামে
সে কারো বোঝা হবেনা বরং ঐ পরিবারের সম্পদে পরিণত হবে। পরবর্তীতে এই শিশুদের হাতের কাজ
শেখানো হবে, পাশাপাশি উন্মুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে যেন একটি শিশু এখান থেকে বের
হয়ে আবার ছিটকে না পড়ে এবং নিজেরা যেন স্বাবলম্বী হতে পারে। কারন অনেকের বয়স বেশী হওয়ায়
নিয়মিত শিক্ষা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে হয়তো এই শিশুদের
অপরাধ প্রবণতা থেকে ফেরানো সম্ভব হবে। আর এভাবেই আগামীতে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ
গড়ায় বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে।